ঢাকা অফিস :
পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের শক্তির উৎস ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের কালো হাত। এ কারণে এদেশের আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বিরোধী কোন ব্যক্তি বা দলকে তারা বরদাস্ত করতে পারত না। কারণ তারা জানে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বিরোধী জনমত গঠন হলে তাদের পতন অনিবার্য। তাইতো তারা এদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে জামায়াতকে টার্গেট করে। আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বিরোধী দেশপ্রেমিক শক্তিকে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে ক্রমাগতভাবে দমন নিপীড়ন চালাতে থাকে।
এজন্য প্রথমে তারা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে, সর্বশেষ তাদের পতনের পূর্ব মুহূর্তে জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পালিয়ে যায়। এদেশের সকলেই জানে জুলাই আন্দোলনের জামায়াত শিবিরের ভূমিকা কি ছিল। ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের তাবেদার ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের পতন ও অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন একই সূত্রে গাঁথা। তাইতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন এবং দেশ পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা একান্ত পরিহার্য। কিন্তু জামায়াতকে তো বিগত ফ্যাসিবাদ সরকার রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সেনাবাহিনীর প্রধান ও সরকার প্রধানের বৈঠক কিংবা যোগাযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাইতো নিজেদের স্বার্থেই তারা এক সপ্তাহের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর উপর রাজনৈতিক নিষিদ্ধকরণের প্রজ্ঞাপনকে আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাতিল বলে ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব কারী দল, যেহেতু জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রবিরোধী কোন অবৈধ সংগঠন ছিল না, কাজেই ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি কোনো দয়া দেখানো হয়নি।
ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের কবল থেকে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ও তার নেতৃবৃন্দকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষী ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জামায়তের একমাত্র কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম আজারুল ইসলাম প্রহসনের বিচারে মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে ফাঁসির দিন গুণতে ছিলেন। নীতিভ্রষ্ট বিচারকরা পালিয়ে গেলে, নিরপেক্ষ বিচারিক আদালত প্রতিষ্ঠা হয়। বিচারিক আদালতের প্রধান দায়িত্ব হয় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। জামায়াতের নেতৃবৃন্দ যেহেতু দেশদ্রোহী নয় , তারা কোন ক্রিমিনাল অভিযোগে অভিযুক্ত নয়, শুধুমাত্র ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতার কারণেই তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সুতরাং দেশপ্রেমিক বিচারক ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী আদালতের প্রধান দায়িত্ব হয়ে যায় জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বেকসুর খালাস দেওয়া। জামায়াত নেতৃবৃন্দকে নির্দোষ প্রমাণিত করে আদালত তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে জামায়াতের প্রতি বিশেষ কোনো করুণা করা হয়নি।
বাংলাদেশের ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংসদের উল্লেখযোগ্য আসনে প্রতিনিধিত্বকারী দল জামায়াত ইসলামী । ফ্যসিবাদী আওয়ামী সরকার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন আইনেরই তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে বিচারিক আদালত ব্যবহার করে সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করে বিচারবিভাগকে কলঙ্কিত করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টায় স্বাধীন বিচারবিভাগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আদালতের প্রধান দায়িত্ব হয়ে যায় বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্ক মুক্ত করা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু গায়ের জোরে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের নিবন্ধন বাতিল করেছিল, তাই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই সেই দলের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়া বিচারিক আদালতের প্রদান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। জামায়াতে ত ইুুউৎ যায় ঋ সলামীর নিবন্ধন বাতিল আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তার দায়িত্ব পালন করেছে। এখানেও সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতকে আলাদা কোনরূপ সুযোগ দেইনি।
ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের তাবেদার নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনকৃত একাধিকবার জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে যে অন্যায় করেছিল, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সেই অবৈধ প্রজ্ঞাপনকে বাতিল করে নির্বাচন কমিশনকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। এখানেও নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর প্রতি বিশেষ কোনো করুণা বর্ষণ করেনি।
জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ভাবে যেমন এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক। তেমনিভাবে জামায়াতের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি দুর্নীতি ও মাদক থেকে মুক্ত। তাঁরা জীবনের বিনিময়ে এদেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। এদেশের দেশপ্রেমিক কোন গোষ্ঠীর সাথেই জামায়াতের নেতা কর্মীর কখনোই মতের অমিল হয় না। কিন্তু যারা চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী দুর্নীতিকে নিজেদের আয়ের উৎস বলে মনে করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের দালালি শুরু করে, তাদের সাথে জামায়াতের মতের অমিল হওয়া অনিবার্য। কারণ জামায়াতের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি দুর্নীতি করার জন্য রাজনীতি করে না, তারা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে জনগণের কল্যাণে কাজ করে, জনগণ থেকে তারা কখনোই বিচ্ছিন্ন হয় না। তাইতো তাদের রাজনীতি করার জন্য আধিপত্যবাদী আগ্রাসী শক্তির দালালি করা প্রয়োজন হয় না। এ কারণেই চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ও দুর্নীতির মূল হোতা রাজনীতির ব্যবসায়ী এবং এদেশের সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র জামায়াতে ইসলামীর অগ্রযাত্রাকে নিজেদের পেটে লাথি দেওয়ার মতো মনে করে।
জামায়াতে ইসলামীর উত্থান মানেই ইনসাফভিত্তিক সমাজ, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ। এমন দেশে তো রাজনীতির ব্যবসায়ী ও অসাধু আমলাতন্ত্রের লুটপাট করে আয়েসি জীবন যাপনের উপায় নেই। তাইতো তারা আন্তর্জাতিক ইসলামবিরোধী চক্র ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসী শক্তির মদদে জোটবদ্ধ হয়ে জামায়াতে ইসলামীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এজন্য সাধারণ মানুষকে তারা উল্টা বুঝায়, জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে শরিয়ার আইন করবে, মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেবে না, হাত কাটবে, দোররা মারবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইভাবে নিজেদের ভয়-ভীতি গুলোকে তারা জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে সফলতা লাভ করে। জনগণ ইসলামী শরিয়ার ইনসাফ ভিত্তিক সমাজকে ভুল বুঝে, তারা বুঝতে পারে না ইসলামী প্রজাতন্ত্রে মেয়েদেরকে বন্দী করে রাখা হয় না, তাদের জন্য অফিস আদালত স্কুল কলেজ ও যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিরাপত্তার স্বার্থে ভিন্ন থাকবে, অভাবে তাড়নায় কেউ চুরি করলে তার শাস্তি হাত কাটা নয়। হাত কাটা যাবে ঐ সকল রাজনীতির ব্যবসায়ী হোমরা-চোমড়া আমলাতন্ত্রের যাদের অভাব না থাকার পরেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করে। প্রকৃতপক্ষে ২/১জন রাঘব বোয়ালের হাত কাটতে পারলেই এদেশ থেকে চাঁদাবাজি ঘুষ ও দুর্নীতি চীরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণের অধিকার হরণ করার, মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে ঘুষ বাণিজ্য করার সাহস কেউ পাবে না, বৈষম্যের শিকার কেউ হবে না। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য এই দেশের, যারা দোষী তারা নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য, নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, ভয়ে ভীত হয়ে ইনসাফ ভিত্তিক ইসলামী শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করে, বিরুদ্ধে কথা বলে। ইনসাফ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হলে সাধারণ নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে কিন্তু সাধারণ জনগণ রাঘব বোয়াল দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের কথায় সবচেয়ে বেশি দিকভ্রষ্ট হয় ।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এ দেশ থেকে সন্ত্রাস চাঁদাবাজ দুর্নীতি ও দখল দারিত্ব দূর হয়নি। জনগণ বারবার বঞ্চিত হয়েছে, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা হরণ করা হয়েছে। সিন্ডিকেট ও রাজনীতির ব্যবসায়ীদের নিকট জনগণের সকল অধিকার লুন্ঠিত হয়েছে। তাইতো এ দেশের শহর বন্দর থেকে শুরু করে নিভৃতপল্লীর আবাল বৃদ্ধ বণিতা আওয়াজ তুলছে এইবার অন্তত একবারের মতো ইনসাফভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা দেখতে চাই। দিকে দিকে আওয়াজ উঠেছে আমরা আর চাঁদাবাজ, দখলদারিত্ব, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জুয়া চাইনা। কিন্তু যারা এসবের সাথে সম্পৃক্ত তাদের দ্বারা যেমন সুশাসন হবেনা, তেমনি চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত ও মাদক মুক্ত দেশও গঠন করা যাবে না। এর জন্য চাই পরীক্ষিত শক্তি। চাঁদাবাজ মুক্ত দুর্নীতিমুক্ত দখলদার মুক্ত নেতাকর্মী। এমন নেতাকর্মী কেবল ইসলামপন্থীরা উপহার দিতে পারে, অন্য কেউ নয়।
জনগণের এই চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন তখনই ঘটতে পারে, যখন দেশের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন দলকানা ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের নিকট নতজানু না হয়ে, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নিজেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। আমরা দেশবাসী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বিচার বিভাগ নির্বাচন কমিশন কাউকেই বর্তমান সময়ের জন্য সাধুবাদ দিতে পারিনা, বরং জনগণের নিকট তারাই দায়বদ্ধ, কারণ জনগণের টাকায় তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আমরা দেখতে চাই এই প্রশাসন এই বিচারালয় এই নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে কতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সঠিকভাবে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বিধিমালা অনুযায়ী সঠিকভাবে পালন করে কিনা। যদি এই প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে শুধু সাধুবাদ নয়, দেশের জনগণ তাদেরকে যুগ যুগ স্মরণ করবে, তাদের জন্য দোয়া করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাত মঙ্গলময় হবে। আর যদি রাজনীতির ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদের শপথ ভঙ্গ করে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না করে, আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের দোসর হয়ে চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে, তাহলে এদেশের জনগণ তাদেরকে কোনদিন ক্ষমা করবে না। জনগণের অভিশাপে তাদের দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই নষ্ট হয়ে যাবে। জনগণ আবার ঐক্যবদ্ধ হবে, এদেশে যেমন কলাপাতার অভাব নেই, তেমনি ভাবে তাঁতিরা অনেক গামছা তৈরি করে। জনগণ রাবারের সস্তা স্যান্ডেল ব্যবহার করে, ভয় নেই কিংবা ভয় আছে, কারণ আগস্ট মাস ফিরে ফিরে আসবেই।
লেখক: ইবনে শাহ
বিশিষ্ট কলাম লেখক ও রাজনীতিবিদ।