এডিশন ডেস্কঃ
দেশের শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলা থেকে প্রতিনিয়ত দালালের মাধ্যমে শিশুদের ৬ মাস মেয়াদি চুক্তিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইটভাটায় পাঠানো হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকা হারিয়ে বহু পরিবার বিকল্প পেশা হিসেবে ইটভাটার কাজ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সঙ্গে আর্থিক সংকটে পড়া পরিবারগুলো আগাম টাকার বিনিময়ে তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের শ্রমে বিকিয়ে দিচ্ছে।
৭ থেকে ১৪ বছর বয়সী এসব শিশু ইটভাটায় মাটির বাহন টানা, কয়লা বহন, ইট তৈরি, পোড়ানো ও শুকানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। এতে শুধু শ্রম আইন লঙ্ঘনই নয়, বরং চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে তারা। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক, শ্বাসযন্ত্র ও রক্তস্বল্পতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ইটভাটার মৌসুম শুরুর আগেই দালাল ও ভাটার সদ্দাররা পরিবারগুলোর সঙ্গে স্ট্যাম্পে চুক্তি করে আগাম টাকা দেয়। মৌসুম শুরু হলে সেই পরিবারের শিশুকে ইটভাটায় পাঠানো বাধ্যতামূলক হয়।
২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর শ্যামনগরের শ্রীফলকাটি গ্রামের মিজানুর রহমান স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকাগামী পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার স্ত্রী সাবিরা বেগম ও দুই মেয়ে মিম (৮) ও জিম (৪) গুরুতর আহত অবস্থায় বর্তমানে চিকিৎসাধীন। পরিবারটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছিল।
১৪ অক্টোবর বিকেলে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ তেলপাম্প এলাকায় তিনজন শিশুকে মালপত্রসহ ঢাকাগামী ভ্যানে দেখা যায়। তারা জানায়, স্থানীয় সদ্দারের মাধ্যমে ইটভাটায় কাজ করতে যাচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জ আটপাড়া গ্রামের আজগার সানা বলেন অভাবের কারণে ১১ বছরের ছেলেকে ইটভাটায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। সদ্দারের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে সংসার চালাচ্ছি।”
ইটভাটার কয়েকজন সদ্দার জানান: “শিশুদের দিয়ে কিছু কাজ করানো সাশ্রয়ী। বড়দের দিলে খরচ বেশি হয়। তাই বিভিন্ন কৌশলে শিশুদের নিয়েই যেতে হচ্ছে।”
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান: গাবুরা থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ইটভাটায় যাচ্ছে, এর মধ্যে ৮ শতাধিক শিশু ও ১ শতাধিক মহিলা। কৈখালী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন: তাদের ইউনিয়ন থেকে ৭ হাজার মানুষ যাচ্ছে, এর মধ্যে ২ হাজারের মতো শিশু শ্রমিক। বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান: সেখান থেকেও প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক, এর মধ্যে ৭ শতাধিক শিশু ও ৫০ জন মহিলা ভাটায় যাচ্ছে।
তাদের তথ্যানুসারে শুধু শ্যামনগর উপজেলা থেকেই প্রতি মৌসুমে ১ লক্ষাধিক মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানের ইটভাটায় কাজ করতে যায়। এর মধ্যে ২৫-৩০ হাজার শিশু এবং ২-৩ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছে।
লিডার্স সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বলেন: “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলে শিশুশ্রম আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ইটভাটায় শিশুরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।”
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন:“ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুরা হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, ত্বকের রোগ ও রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত হচ্ছে।”
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি খাতুন বলেন: “আমরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালাচ্ছি। কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে যে শিশুদের ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”