খুলনা এডিশন::
মৎস্য অধ্যুষিত উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছায় প্রতিবছর বাড়ছে মৎস্য চাষ। চাষের সাথে বাড়ছে উৎপাদন। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ও মৎস্য চাষ ও উৎপাদন। রোগ বালাই সহ বৈশ্বিক নানা পরিস্থিতির মধ্যে ও উৎপাদন বৃদ্ধি, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এখানকার মৎস্য চাষিরা। মৎস্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী অত্র এলাকা থেকে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ২৭ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য। যার মধ্যে চিংড়ী, সাদা মাছ, কাঁকড়া ও কুচিয়া অন্যতম।
সূত্র অনুযায়ী ৮০’র দশকের পর হতে উপকূলীয় এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভাবে শুরু হয় সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ী চাষ। সুন্দরবন সংলগ্ন এ অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়। ফলে এ অঞ্চল মৎস্য চাষের জন্য উপযোগী ও অত্যন্ত সমৃদ্ধ । এ কারণে চিংড়ী চাষ ব্যবস্থা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। চিংড়ি চাষ মানেই শুধু সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ী নয়। চিংড়ির সাথেই মিশ্র চাষ হয় টেংরা, পারশে, ভেটকি, ভাঙ্গন সহ বিভিন্ন প্রজাতির অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন সাদা মাছ ও কাঁকড়া। চিংড়ি চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চিংড়ি চাষাবাদ। অন্যান্য পেশে থেকে সবাই এগিয়ে আসতে থাকে চিংড়ী চাষে। বিগত ৪ দশকের ব্যবধানে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ মৎস্য চাষ এবং সংশ্লিষ্ট এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়। যদিও শুরুটা যতটা সহজ ছিল, এখন অতটা সহজ নেই চিংড়ী চাষ ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে একদিকে যেমন বেড়েছে রোগ বালাই সহ নানা সমস্যা। তেমনি চাষ ব্যবস্থায় ও এসেছে কিছুটা পরিবর্তন। আগে চাষিরা সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতো। এটা অনেক সহজ এবং উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম ছিল। এখন উন্নত সনাতন ব্যবস্থা সহ চিংড়ী কিংবা মৎস্য চাষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে চাষিরা। এতে উৎপাদন বাড়লে ও বেড়েছে ঝুঁকি এবং উৎপাদন খরচ। রোগ বালাই বৃদ্ধি পাওয়ায় চিংড়ি চাষ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে চাষিদের। ফলে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ও মৎস্য চাষ ব্যবস্থা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এখানকার চাষিরা। প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সহ চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করছে মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। যদিও চিংড়ী চাষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ও সরকারের সর্বাত্মক সহোযোগিতা জরুরি বলে মনে করছেন এখানকার চাষিরা। মৎস্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী অত্র উপজেলায় মৎস্য উৎপাদন ও আহরণের যেসব উৎস আছে তারমধ্যে রয়েছে অন্যতম হচ্ছে মৎস্য ঘের। যার বর্তমান সংখ্যা ৮ হাজার ৫৮০ টি, দীঘি এবং পুকুর রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৩টি, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার রয়েছে ৪টি, ভেনামী চিংড়ী খামার রয়েছে ১ টি, নদ-নদী রয়েছে ১০ টি, খাল ১৩২ টি, কাঁকড়া খামার ১৭ হাজার ৭৫ টি এবং গলদা খামার ২২৫ টি। এসব উৎস থেকে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ২৭ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য। যার মধ্যে চিংড়ী ৫ হাজার ৮৮৪ মেট্রিক টন, সাদা মাছ ১৮ হাজার ২৮৩ মেট্রিক টন, কাঁকড়া ৩ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন ও কুচিয়া ২০.৭৫ মেট্রিক টন।
এখানকার উৎপাদিত চিংড়ি, কাঁকড়া, কুচিয়া ও অন্যান্য সুস্বাদু সাদা মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছর চিংড়ি এবং মাছের দাম বেশি হওয়ায় বেশি লাভের আশা করছেন চাষিরা। কাঁকড়া ব্যবসায়ী কৃষ্ণপদ মন্ডল বলেন গত বছরের তুলনায় এ বছর কাঁকড়া কেজি প্রতি ২’শ থেকে ৩’শ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে ৯০ গ্রাম কাঁকড়া ৫৫০ থেকে ৬৫০, ডাবল এফ ওয়ান ১৪৫০ এবং ডাবল এক্সেল ৯৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মৎস্য আড়ৎদারি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল মোড়ল বলেন ভেটকি ৪৫০ থেকে ৭৫০, পারশে ৩০০ থেকে ৭৫০, টেংরা ২৫০ থেকে ৬৫০, দাতিনা ২০০ থেকে ৫০০, চিত্রা ২৫০ থেকে ৪০০, রুই ২০০ এবং তেলাপিয়া ৫০ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চিংড়ি ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান মোড়ল বলেন বাগদা চিংড়ী ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের চেয়ে কেজি প্রতি ২’শ- ৩’শ টাকা বেশি। মৎস্য খাত শুধু অর্থনীতিতে অবদান রাখছে না, আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পোনা ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন জানান স্থানীয় এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আনা পোনা এলাকার চাহিদা পূরণ করে থাকে। তিনি বলেন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৪০ টি হ্যাচারি এবং কক্সবাজারের কমপক্ষে ৩০ টি হ্যাচারীর পোনা এলাকায় সরবরাহ করা হয়। উপজেলায় কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ টি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এবং এর সাথে প্রায় ১০ হাজার মানুষ কর্মরত রয়েছে। মৎস্য খাতে কাজ করে হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে।
মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি সরুপ এলাকার একাধিক ব্যক্তি জাতীয় মৎস্য পুরুস্কার অর্জন করেছেন। চলতি বছর ও অত্র এলাকার উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া রিপন জাতীয় মৎস্য পুরস্কার লাভ করেছেন। মানসম্মত এবং ভাইরাস মুক্ত পোনা প্রাপ্তি সহজ, সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মৎস্য পদকপ্রাপ্ত চিংড়ি চাষি গোলাম কিবরিয়া রিপন।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক জানান উৎপাদন বৃদ্ধি, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তিনি বলেন মৎস্য চাষে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, এ কারণে উৎপাদন ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরে অত্র উপজেলা থেকে ২৭ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে বলে মৎস্য দপ্তরের উপজেলা পর্যায়ের এ কর্মকর্তা জানান।