খুলনা এডিশন::
সাতক্ষীরা সীমান্তে প্রায় ২২ কোটি টাকার মাদক জব্দ করেছে ৩৩ ব্যাটালিয়ান (বিজিবি) এর চৌকস টিম। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে মাদক প্রবেশ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ ও সংগঠিত স্রোতে। দিনে-রাতে, স্থলপথ ও নদীপথ ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে প্রবেশ করছে আইস, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও ভারতীয় মদ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি মাঝে মাঝে বড় অঙ্কের মাদক জব্দ করলেও সংশ্লিষ্টদের মতে, ধরা পড়ছে কেবল দৃশ্যমান অংশ—মূল সিন্ডিকেট থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দেশের পশ্চিম সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলা এখন আর শুধু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নয়, এটি কার্যত দেশের অন্যতম বড় মাদক করিডোরে পরিণত হয়েছে। জেলার ভোমরা, কাকডাঙ্গা, ঝাউডাঙ্গা, মাদরা ও রইচপুর সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাদক চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে। বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা, জঙ্গল, নদী ও জনবসতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শক্তিশালী চক্র নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ন (৩৩ বিজিবি) একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। ব্যাটালিয়ন সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে সদর উপজেলার রইচপুর এলাকায় চালানো ওই অভিযানে মালিকবিহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪ কেজি ২৫০ গ্রাম আইস (মেথামফেটামিন), ৪০ বোতল উইনসারেক্স (Wincerex) সিরাপ এবং একটি মোটরসাইকেল। জব্দকৃত মাদকের আনুমানিক বাজারমূল্য ২১ কোটি ২৬ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা।
বিজিবি সূত্র জানায়, অভিযানের সময় সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল থামানোর সংকেত দিলে সে মোটরসাইকেল ও সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগ ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে তল্লাশি চালিয়ে ফেলে যাওয়া ব্যাগ ও মোটরসাইকেল থেকে এসব মাদক উদ্ধার করা হয়।
সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ন (৩৩ বিজিবি)-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী আশিকুর রহমান জানান, জব্দকৃত মাদকদ্রব্যের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। পরবর্তীতে জনসম্মুখে ধ্বংসের লক্ষ্যে এসব মাদক ব্যাটালিয়নের সিজার স্টোরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ন (৩৩ বিজিবি) একাধিক বড় মাদক চালান জব্দ করলেও সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, এসব জব্দ মোট প্রবাহের খুবই সামান্য অংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযানের সময় চোরাকারবারীরা পালিয়ে গেলেও গডফাদাররা থেকে যায় আড়ালে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, সীমান্তের দুই পাশের যোগসাজশ এবং অর্থপাচারনির্ভর শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই মাদক ব্যবসার মূল শক্তি। নাম জানা থাকলেও এসব হোতারা খুব কম ক্ষেত্রেই আইনের আওতায় আসে। সহজ আয়ের লোভে সীমান্ত এলাকার বেকার তরুণরা বাহক হিসেবে জড়িয়ে পড়ছে এই অপরাধে। আজ বাহক, কাল নেশাগ্রস্ত—এভাবেই ধ্বংসের পথে যাচ্ছে একটি পুরো প্রজন্ম।
এদিকে বিজিবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে। জব্দ ও মামলা হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মাদকের প্রভাবে সীমান্ত এলাকাসহ পুরো জেলায় বেড়েছে চুরি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংসহ নানা সামাজিক অপরাধ।
জেলার সচেতন মহলের মতে, সীমান্তে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বৃদ্ধি, বড় সিন্ডিকেটের আর্থিক উৎসে আঘাত, রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষা করে কঠোর অভিযান এবং একটি যৌথ গোয়েন্দা টাস্কফোর্স গঠন এখন সময়ের দাবি।
মাদক এখন আর কেবল সীমান্ত অপরাধ নয়—এটি সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। দ্রুত কঠোর ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত না নিলে সীমান্ত জেলা নয়, গোটা দেশই মাদকের করিডোরে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।