ঢাকা অফিস:
নজরদারির জন্য আগে যেসব ড্রোন ব্যবহার করা হতো, তা শব্দ করে উড়ত। তবে এখনকার পাখি-আকৃতির এ নতুন ড্রোনগুলো যেন একেবারে প্রকৃতিরই অংশ। এগুলো ডানা মেলে উড়ে, ঘুরে বেড়ায় আবার বিশ্রাম নিতেও বসে কোথাও। সবই জীবন্ত পাখির মতো।
এ ড্রোনগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে বিভিন্ন পাখির আকৃতিতে। যেমন- ম্যাগপাই, গাংচিল, বাজপাখি ইত্যাদি। শহরে ছোট পাখির মতো আর প্রাকৃতিক এলাকায় বড় পাখির মতো ব্যবহার করা হয় এসব ড্রোনকে।
অবাক মনে দেখছেন আকাশে উড়ছে এক ঝাঁক পাখি। হয়তো কাক বা মাছরাঙা। তবে ভালোভাবে দেখলেই বুঝবেন যে, এগুলো পাখির ঝাঁক না। এগুলো আসলে যন্ত্র। ডানা খুব নিখুঁতভাবে ঝাপটাচ্ছে তারা, চলাফেরায় অস্বাভাবিক রকমের শৃঙ্খলা, নেই কোনো কিচিরমিচির শব্দ।
<[ ইরানের পরমাণু প্রকল্প রক্ষার করবে রাশিয়া: পুতিন]>
হুবহু পাখির মতো এগুলো আসলে ড্রোন। নীরবে করবে নজরদারি, আঘাত হানবে নিঃশব্দে। তবু টের পাবে না কেউ। ৯০ গ্রামের ম্যাগপাই ড্রোন থেকে শুরু করে বিশাল ঈগল আকৃতির সশস্ত্র ড্রোন- চীনে সবই তৈরি হয়েছে গোপনে যুদ্ধ চালানোর জন্য।
অন্যদিকে বড় ঈগল-আকৃতির ড্রোনগুলো ৪০ মিনিট পর্যন্ত টানা উড়তে পারে, যেতে পারে ৮ কিলোমিটার দূর। এগুলোতে ছোট মিসাইলও বসানো যায়। এ ছাড়া আছে হামিংবার্ড নামের ড্রোন, যার ওজন ১০ কেজি এবং এটি ৭ কেজি ওজনের বিস্ফোরক নিয়ে আক্রমণ করতে পারে সহজেই। যে কোনো সৈনিক এ ড্রোন নিজে বহন করতে পারে এবং নিজেই ব্যবহার করতে পারে।
ড্রোনের ফলে পাল্টাচ্ছে যুদ্ধের ধরন:
এখন আর শুধু যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টার নয়, ছোট-বড় পাখির মতো ড্রোন দিয়েও নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হচ্ছে আকাশের। একসঙ্গে অনেক ড্রোন ছেড়ে একযোগে নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ এবং আক্রমণ চালানোও সম্ভব হচ্ছে।
ডানাগুলো পাখির পাখার মতো ঝাপটালেও এতে তেমন শব্দ হয় না। রাডারও বুঝতে পারে না এটা ড্রোন। এগুলোর শরীর হালকা রাবারের মতো পদার্থে দিয়ে তৈরি, তাই নমনীয় হলেও মজবুত। ছোট ম্যাগপাই ড্রোনগুলোতে আছে ক্যামেরা। ঈগল-আকৃতির ড্রোন দুই মিটার পর্যন্ত ডানা মেলে উড়তে পারে এবং বোমাও বহন করতে পারে।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাখি ড্রোনের বিস্তার:
এ প্রযুক্তি আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো শুধু নজরদারির কাজে ব্যবহার হতো। তবে এখন এগুলো শত্রুদের আক্রমণের কাজেও ব্যবহার করা হয়। ছোট ম্যাগপাই ড্রোনগুলো শহরের ভেতরে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে বেড়ায়। একাধিক ড্রোন একসঙ্গে কাজ করায় শত্রুদের নজরদারিতেও পড়ে না।
আন্তর্জাতিক আইন এখনো এমন প্রযুক্তির জন্য তৈরি নয়। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এগুলো ছড়িয়ে পড়লে বিপদ আরও বাড়তে পারে। এক সময় হয়তো অন্য দেশ বা সন্ত্রাসীরা এমন ড্রোন বানিয়ে ভুল কাজেও ব্যবহার করতে পারে। এ প্রযুক্তিগুলোকে দ্রুত আইনের আওতায় না আনা গেলে এ ধরনের বিপদ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এমন বাস্তবতায় মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বেশি, সেখানে এ প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে আরও বেশি আতঙ্কিত করা সম্ভব।
এটা শুধু প্রযুক্তির প্রশ্ন না, এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। ড্রোন যদি প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যায়, তবে যুদ্ধও আর যুদ্ধের মতো দেখা যায় না। আর তাই এটি নিয়ে সবার আলোচনা ও চিন্তা করা জরুরি।
পাখির মতো দেখতে ড্রোন শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন না, বরং এটা একটি নতুন যুগের সূচনা। যেখানে যুদ্ধ আর খোলা আকাশে নয়, আকাশে থাকা নিরীহ পাখি থেকেও আসতে পারে বিপদ।
এ পদ্ধতিতে শত্রু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমণ করে ফেলা যায় সহজেই। ম্যাগপাই ড্রোনগুলো একত্রে উড়ে শহরের অলিগলি পর্যবেক্ষণ করে বেড়ায়। এমনকি শত্রুর রাডারকেও করে বিভ্রান্ত। বড় ড্রোনগুলোও একইভাবে ব্যবহার করা যায় প্রয়োজনমতো। ফলে ছোট এ সেনাদলগুলো নিজেরাই আকাশে আক্রমণ চালাতে পারে উচ্চ কমান্ডের সাহায্য ছাড়াই, নিজে নিজেই।
এ প্রযুক্তি বিশেষ করে কাজে লাগে সেসব এলাকায়, যেখানে জিপিএস সিগন্যাল বন্ধ থাকে বা যুদ্ধবিমান পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়। এগুলো আধা-স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে, তাই সিগন্যাল না থাকলেও চলতে পারে।
প্রতিরোধ আর নৈতিকতার প্রশ্ন:
চীন শুধু ড্রোন বানাচ্ছে না; বরং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও তৈরি করছে। কে-২৫ নামের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবস্থা ছোট ড্রোন চিনে ফেলতে পারে এবং ২০০ মিটার দূর থেকে তা লক্ষ্য করে গুলি করতে পারে। এতে ৯০ শতাংশ সফলতার হারও দেখা গেছে।
তবে ড্রোনগুলো দেখতে পাখির মতো হওয়ায়, এগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন। রাডার, ক্যামেরা, এমনকি তাপমাত্রা শনাক্ত করতে পারা যন্ত্রও এগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারে। এতে নিরাপত্তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন আসে সহজেই। সাধারণ মানুষ জানে না বা বুঝতেও পারেন না, তারা কখন-কোথা থেকে নজরদারিতে আছে। একটি পাখি যে আসলে ড্রোন হতে পারে- এই ভাবনাই সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াতে যথেষ্ট।