এ অঞ্চলের পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় যুদ্ধ বেধে যাওয়া ও হতাহতের ঘটনায় নানা হুমকি তৈরি হয়েছে। এর বাইরে আরও বড় বিপদ রয়েছে। অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের যে বিপর্যয় ডেকে আনবে, তাতে যে দেশই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করুক না কেন, ক্ষয়ক্ষতির ফলে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হবে। এখন সময় হয়েছে, দুই দেশের যুদ্ধংদেহী উত্তেজনা বন্ধ করা ও সংকট সমাধানের পথ বের করা।
কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। দেশ দুটিই এখন যুদ্ধংদেহী অবস্থায়। গত দুই দশকের মধ্যে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ এ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান একে অন্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে পাল্টাপাল্টি বয়ান।
ভারত-পাকিস্তানের এ যুদ্ধের দামামার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি প্রক্রিয়ার এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু এ আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান অংশীদার, সেহেতু প্রশ্ন হলো—এ উত্তেজনামূলক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী হওয়া উচিত? ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি এ অঞ্চলে নতুন নয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সবসময় দক্ষ, বুদ্ধিমান ও দায়িত্বশীল অংশীদারের ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বিবদমান পক্ষের ওপর ন্যস্ত করে সমস্যার সমাধান আরও গতিশীল রেখেছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের মূল অস্ত্র ছিল ‘বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষতা’। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মূলমন্ত্র ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ ছিল এ নিরপেক্ষতার চালিকাশক্তি। ফলে আঞ্চলিক এ দ্বন্দ্বের মধ্যেও আঞ্চলিক পর্যায়ে অবাধ বিচরণে বাংলাদেশের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ এ নিরপেক্ষতা সবপক্ষের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে।
এরই মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার পরপর উভয় দেশের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশ। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতে যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, সেই ইতিহাস সংযত হওয়ার শিক্ষা দেয়। ১৯৯৯ সালে খুব সীমিত পরিসরে মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী কারগিল যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের পুঁজিবাজারে ধস নেমেছিল। বাজার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলেও বৈরিতা দীর্ঘদিন ধরে চলায় অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছিল মারাত্মক। পরবর্তী অর্থবছরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ১ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা সংঘাতের সময় আমরা দেখেছি, মাত্র এক সপ্তাহের উত্তেজনায় দুই দেশের পুঁজিবাজারে ক্ষতির পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। এখন যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে ধ্বংসযজ্ঞ আরও অনেক বেশি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই দেশের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলেই পড়বে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। কাশ্মীরে যখনই কিছু হয়, ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। আবার বেলুচিস্তানে কিছু হলে পাকিস্তান ভারতকে দায়ী করে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা পাল্টাপাল্টি কিছু ব্যবস্থা নেয়। এখন কথা হচ্ছে, এ পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা কোথায় গড়াতে পারে? তারা আরও মনে করেন, এ দুই দেশের মধ্যে বড় আকারে যুদ্ধের সম্ভাবনা তেমন নেই। দুটো দেশেরই পারমাণবিক সক্ষমতা আছে। কিন্তু তাদের জনগণ বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করি না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলব, তারা বড় যুদ্ধে জড়াবে না। হয়তো পাল্টাপাল্টি ওই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শেষ পরিণতি নির্ভর করবে যুদ্ধ কতটা বিস্তৃত হয়, তা পারমাণবিক পর্যায়ে গড়ায় কি না এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের মাত্রার ওপর। তবে এ যুদ্ধ সংঘটিত হলে মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। মানবিক বিপর্যয়ের ফলে বড় আকারের প্রাণহানি, উদ্বাস্তু সংকট এবং নাগরিক জীবনের ব্যাপক ক্ষতি হতে বাধ্য। উভয় দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে তা শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। ফলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। চলমান অবস্থায় যদি কোনো এক পক্ষ স্পষ্ট বিজয় অর্জন করে, তাহলে সীমান্তে পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণে পরিবর্তন হতে পারে, বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, উপমহাদেশের যে কোনো ঘটনার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর থাকে এবং দেশের নাগরিকদের মধ্যেও এর নানাবিধ প্রতিক্রিয়া হয়। এ উত্তেজনার কারণে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আরেকটু জটিল হলো। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমেই ভারত একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি (সিন্ধু পানি চুক্তি) স্থগিত করেছে। ভারতের দিক থেকে এটা আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন হলো। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তথা আগামী বছর বিজেপি বিহার ও পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় আসার জন্য যে জনমতটা তৈরি করতে চাচ্ছে, তার জন্য মুসলমানবিরোধী রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য জটিলতা বাড়াবে। কারণ মাত্রই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এসেছে দেশটি।
এসব সম্ভাব্য বিপর্যয় ও পরিণতির কথা বিবেচনা করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের নিষ্ক্রিয় উদ্বেগ দেখানোর জায়গা থেকে সরে এসে ইসলামাবাদ ও দিল্লির ওপর সক্রিয় হস্তক্ষেপ এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের উচিত ওআইসিসহ অন্যান্য ফোরামকে বলা যে, কাশ্মীর ইস্যুটা স্থায়ীভাবে সমাধান করা উচিত। তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনার উৎসটা বন্ধ হবে। এ মুহূর্তেই বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রাখতে হবে, শুধু দর্শক হয়ে থাকলে হবে না। আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয়ভাবে ভয়েস রেইজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের উচিত ভাবমূর্তিটা এমনভাবে তৈরি করা, ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে। অন্যদিকে ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনা সাম্প্রদায়িক রূপ নেওয়ার ব্যাপারটিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে যথাযথভাবে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান অবশ্যই করতে হবে। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন অচলাবস্থা তো বেশি দিন চলতে পারে না। এ ট্র্যাজেডি হয়তো নতুন কোনো মোড় নিতে পারে। এ সংকটে বাংলাদেশের উচিত হবে সরকারের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করা। এ অঞ্চলে বড় ধরনের যুদ্ধ যেন না হয়, সেটাই আমাদের সবার কাম্য। যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি এবং যুদ্ধটা গুজবে শেষ হলেই শুভ হয়, ভালো হয়। যদি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে, বাংলাদেশের উচিত হবে ওই যুদ্ধের অংশভাগী না হওয়া।
শেষ কথা, যুদ্ধ কখনো কারও জন্য শান্তি বয়ে আনে না। আমাদের উচিত শান্তি ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক