ঢাকা অফিস:
ধর্মীয় পৌরহিত্য পৃথিবীর সকল ধর্মের মধ্যেই কমবেশি আছে। এই পৌরহিত্য যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন দেশ এবং জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পৌরহিত্য থেকে আমরা কোনভাবেই মুক্তি পাচ্ছিনা। ধর্মীয় নেতা ও গুরুদের কারণে ধর্মের সঠিক নিয়ম বাস্তবায়ন বা ধর্মীয় সংস্কার যেমন সম্ভব হয় না, ঠিক তেমনি ভাবে রাজনৈতিক পৌরহিত্যের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। পৌরহিত্যের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলছে।
ধর্মীয় নেতা বা গুরুরা মনে করে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার খাস প্রতিনিধি বা অবতার। তাঁরা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, দুধের সর, ননী ঘি শুধুমাত্র তারা একা একাই খাবে। অন্যরা তাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করবে, শ্রদ্ধা করবে, বিনম্র থাকবে, দান দক্ষিণা দিবে, তাঁরা শুধু গ্রহণ করবে কিন্তু কিছুই দেবে না।
আরেকটি বিষয় হলো ধর্মীয় পুরোহিতরা সাধারণ জনগণের তুলনায় নিজেদেরকে উচ্চবর্নের বা সর্বোত্তম মনে করে, তাইতো ধর্মীয় পুরোহিতরা নিজেদের মধ্যে একটা গোত্র তৈরি করে ফেলে যে কোন পরিস্থিতিতেই একে অপরের সাথে মিলে নিজগোত্রের মান সম্মান রক্ষা করে। ঠিক তেমনি ভাবে রাজনৈতিক পুরোহিতরাও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের মধ্যে একটি সার্কেল গড়ে তোলে। ন্যায় অন্যায়, দুর্নীতি স্বার্থপরতা, অর্থ আত্মসাৎ যাই ঘটুক না কেন রাজনৈতিক পুরোহিতদের এই সার্কেল বেশ নিরাপদ।
আমাদের দেশে ডানপন্থী সেকুলার রাজনৈতিক দলের কর্মী বাহিনী যা কিছুই করুক না কেন, এতে কোনো অসুবিধা নেই কারণ উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ নির্দিষ্ট হারে “ভোগ” পেয়েই থাকেন। চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট দুর্নীতি জুয়া কিংবা মাদকের আসর যাই হোক না কেন রাজনৈতিক গুরুর নিকট নির্দিষ্ট “ভোগ” পৌছাইতে পারলে সাত খুন মাফ। নেতারা জনগণের চোখে পড়ার মত কিছু কাজ করে, আইন-শৃঙ্খ রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মাঝে লজ দখলদার, চাঁদাবাজ, সিন্ডিকেট সৃষ্টিকারী, মাদক ও জুয়ার আসরের কর্মী বা চুনুপুটিদের বিরুদ্ধেঅভিযান পরিচালনা করেন, গ্রেফতার করেন জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। এতে কিন্ত ঐসব অপকর্ম ও অপকৃত্তি বন্ধ হয় না,, কারণ রাজনৈতিক পুরোহিত বা গডফাদার সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাঁরা অন্য কর্মীদেরকে সেই সব কাজে নতুন করে নিযুক্ত করে। প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুশি হয় যে তারা অ্যাকশন নিয়েছে, রাজনৈতিক পুরোহিতরা জোর গলায় বক্তৃতা বিবৃতি দেয় চাঁদাবাজ দখলদার সন্ত্রাসী মাদক ও জুয়ার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলছে চলবে। আবার অনেক সময় বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে গেলে অর্থাৎ কর্মীরা নেতার আনুগত্য কিংবা সঠিক ভাগ বাটোয়ারা অনুযায়ী “ভোগ” ঠিকমতো না দিলে নেতারা অ্যাকশন নিয়ে থাকেন, কারণ ওস্তাদের মাইর শেষ রাত্রে। এভাবেই হাত বদল হয়, রাজনৈতিক পুরোহিত বদল হয় কিন্তু অপকর্ম বন্ধ হয় না। দেশ এবং দেশের নিরীহ জনগণ মুক্তি পায় না।
জনগণ মুক্তি না পেলেও দলীয়কর্মীরা নেতাদের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে দখল বাণিজ্য ও অবাধ চাঁদাবাজি চলতে থাকে। কোন ভয় ভীতি নেই, সমস্যা হলে নেতা আছেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “লাভে লোহা বহন করে, বিনা লাভে তুলাও বহন করে না”! নেতারা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে কর্মীদের জন্য সুপারিশ, সিন্ডিকেট গঠন করে দেয়। এছাড়াও প্রভাব বিস্তার, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রমোশন কিংবা সুবিধা জনক স্থানে বদলীর জন্য নেতারা জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করে। অসুখ বিসুখে নেতারা যার যেমন সামর্থ্য তাই দিয়ে কর্মীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে। কারণ তারা মনে করে এই কর্মীরাই তাদের সম্পদ, এই কর্মীরা ভালোভাবে বাঁচলেই তারাও বাঁচবে, কর্মীদের ব্যক্তিগত উন্নতির সাথে তাঁদের নিজেদেরও ব্যক্তিগত উন্নতি জড়িয়ে আছে।
এক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোর কর্মীদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। শুধুমাত্র সাংগঠনিক কাজকর্ম ছাড়া নেতাদের নিকট কর্মীদের কোন মূল্য নেই। হয়তো এর প্রধান কারণ ডানপন্থী কিংবা সেকুলার নেতাদের মত ইসলামপন্থী নেতারা সরাসরি কর্মীদের নিকট থেকে “ভোগ” পায় না, কারণ কর্মীদের দান-দক্ষিনা সংগঠনের তহবিলে জমা হয়। সংগঠনের তহবিলের জমা দেওয়াকে কর্মী সমর্থকেরা সওয়াবের কাজ মনে করে, কেউ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কোনরূপ আশা পোষণ করে না। তাইতো নেতারা সাধারণ কর্মী সমর্থকদের খোঁজখবর নেওয়া কিংবা তাদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না। সাংগঠনিক সিস্টেমে সবকিছু হয়ে যায়।
আরেকটি বিষয় হলো ইসলামপন্থী নেতাদের শুধুমাত্র সাংগঠনিক কাজকর্ম ছাড়া ব্যবসায়িক বা প্রশাসনিক বিষয়ে পদচারণা খুব কম। সারাদেশে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ৯৯% দায়িত্বশীলের পেশা চাকুরী ও ছোটখাটো ব্যবসা। এঁদের মধ্যে যেমন জাতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেই, তেমনি নেতাকর্মীরাও সরকরী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য কি সেটাও বুঝে না।
এদেশের ডানপন্থী ও সেক্যুলা রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের সভাপতি/সেক্রেটারি থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক জীবনের প্রথমপাঠ শুরু হয় ঠিকাদারি, টেন্ডার, সিডিউল, নেগোসিয়েশন এর মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে ছাত্র ও পেশাজীবিসহ অন্যান্য সকল অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ রাজনীতির পাশাপাশি এসব ব্যবসায় অভিজ্ঞতা লাভের সাথে বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে যায়। তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগ– নির্বাহী, বিচার ও দেশ রক্ষা বিভাগে সরবরাহ, নির্মান ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ছায়া সরকারের অভিজ্ঞতা লাভ করে। ঐ সব ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে। কালক্রমে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়, আর উপজেলা জেলা পর্যায়ে নেতারাও এমপি মন্ত্রী হয়ে যায়। একেই বলে–“সোনায় সোহাগা”! মন্ত্রী-এমপি ও প্রশাসন একে অপরের পুরানো দোস্ত, কারো কোন দ্বিধা সংকোচ নেই।
অন্যদিকে ইসলামপন্থী নেতাদের সাথে প্রশাসনের দুই একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ হলেও সেটা মনে থাকার মত নয়। কিন্তু দিনের পর দিন ব্যবসায়িক খাতিরে যাওয়া-আসা কাজকর্ম লেনদেনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের সাথে প্রশাসনের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, সে রূপ সম্পর্ক না থাকার কারণেই ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে প্রশাসনে সর্বত্র ভীতি বিরাজ করে। এই ভীতি ইসলামপন্থীদের উপরে ওঠার পথ রোধ করে দেয়।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবসায়ী নেতা-নেত্রীরা আগেভাগেই যেমন অবগত হয়, তেমনি সঠিক স্থানে সঠিক সময়ে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কাকে কিভাবে সাহায্য করা যাবে সেটা তাদের নখদর্পণে থাকে। সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য তারা এক পায়ে খাড়া, কারন তারা জানে, যেকোন সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য সহযোগিতা করা হোক না কেন, এর প্রতিদান তারা হাতে হাতে পাবেন। তাইতো বাঘের চোখ এনে দেওয়ার জন্য তারা হাত বাড়াতেও দ্বিধাবোধ করে না।
এ সব ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দলের নেতৃত্ব অসহায় ও অক্ষম। ছাত্র জীবনে শুধু জেলা নয়, কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি, কিংবা সেক্রেটারিয়েট পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছেন তারাও ছাত্র জীবন শেষ করে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে, ব্যবসা করার জন্য স্কুল কলেজ, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, কিংবা নার্সিংহোম বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিকল্প ভাবতে পারেনা। ভাগ্য ভালো হলে সাংগঠনিক ফুল টাইমার হিসেবে জীবন পার করে দেন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা বা দায়িত্বশীলগণ সংগঠনের বায়তুল মালের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কিন্তু সকলকে তো আর সংগঠনের ফুল টাইম দায়িত্বে নিয়োজিত করা যায় না। বাধ্য হয়ে বাকিরা চাকরিকে জীবনে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। মূলত এইসব কারণেই ইসলামপন্থী নেতাদের ব্যক্তিগত কোন কাজে কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয়তঃ সাংগঠনিক দক্ষতার বাইরে সামাজিক ব্যবসায়িক কিংবা প্রশাসনিক বিষয়ে তারা থাকেন একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে কোন পরামর্শ কিংবা সাহায্য করা যায় না, তাই দেখা যায় কোন কর্মী সাহায্য প্রার্থী হলে নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য বৈধ অবৈধের দোহাই দিয়ে ১৪ গুষ্টির খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে। কারণ এক অন্ধ অন্য অন্ধকে পথ দেখাতে পারেনা। খেতে জানে না তাই খাওয়াতেও পারে না। একপর্যায়ে কর্মীরা বিরক্ত হয়ে নেতার কাছে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়।
অনেক সময় দেখা যায় প্রশাসনিক সাহায্যের জন্য ইসলামপন্থীরা কর্মীর মান খুঁজে। কিন্তু অন্যান্য দলের কর্মী শুধু নয় তাদের পরিচিত, পাড়াতো খালাতো মামাতো ভাই-বোনদেরকে নেতারা সর্বোচ্চ সুপারিশসহ সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তারপরও রাজনৈতি অঙ্গনে খুবই আলোচিত বিষয় হলো ইসলামপন্থী নির্যাতিত কর্মী ও তার পরিবারকে যথা উপযুক্ত সাহায্য সহযোগিতা পায়। এটা অত্যন্ত সত্যি কথা কিন্তু এখানেও নেতার কোনো বাহাদুরি নেই। বাহাদুরি হলো সেই সব কর্মী সমর্থক ও সুধীদের যাদের প্রতি মাসের এয়ানতের জমানো টাকা থেকেই বিপদ আপদে সংগঠনের জন্য খরচ করা হয়।
ছোট পরিবার সুখী পরিবার ছিল–কিন্তু পরিবার তো এখন বড় হয়ে গণপরিবারের আকার ধারণ করছে, ভিন্ন মতের উদ্দেশ্যের কত লোক এই পরিবারের ঠাঁই নিচ্ছে, সবাইকে নিয়ে পথ চলতে হবে। এজন্য সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি, রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে সামনে এগিয়ে আনতে হবে। পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনার গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে ইসলামপন্থীদের তুলনায় অন্যরা অনেক বেশি পরিপক্ক। ইসলামী সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রমাণিত হলেও নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে কতটুকু সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত এটা সামাজিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। এখন তো– “পাই না তাই খাই না” চলছে, যখন অনেক কিছু খাওয়ার থাকবে, তখন বোঝা যাবে “কে কত খায় না”।
দিন বদলে গেছে, সকল স্তরের নেতাকর্মীকে সততা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করতে হবে। তাহলেই ছায়া সরকারের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যাবে। ছায়া সরকারের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে জনগণের আস্থা অর্জন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সক্ষম হবে। এজন্য বর্তমান নেতৃবৃন্দকে সবচেয়ে বেশি সেক্রিফাইস করতে হবে। তা হলেই হয়তো রাজনৈতিক পৌরহিত্যের দৌরাত্ম্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।