ঢাকা অফিস:
তিন চার মাসের শিশু পুত্র রেখে মা ইন্তেকাল করলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমা ঘরে এসেই মৃত সতীনের পুত্রকে বুকে টেনে নিল, কোল থেকে নামতে দেয় না। কোলের মধ্যে রেখেই খানাপিনা প্রসাব-পায়খানা সবকিছু, এমনকি রাত্রিবেলাও বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সকলে বলে আহা এমন সৎ মা দেখিনি। কিছুদিন পরে যখন সৎ মায়ের পুত্র সন্তান জন্ম নিলো, তখন নিজের পেটের সন্তান কাদামাটিতে লুটোপুটি করে, হামাগুড়ি দিয়ে চলে, কিন্তু সতীনের পুত্রকে বুকে আগলে রাখে কখনোই মাটিতে নামতে দেয় না। চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠলো এমন সৎ মা হয় না।
এভাবে কয়েক বছর কেটে গেল, নিজের ছেলে মাটিতে হামাগুড়ি খেতে খেতে হাঁটা শিখলো, দৌড়াতে শিখলো সে এখন নিজের কাজ নিজেই করতে পারে। কিন্তু সতীনের পুত্রকে যেহেতু কোল থেকে কখনোই নামতে দেয় না, তাই সতীনের পুত্রের হাত পা গুলো চিকন চিকন হয়ে গেল, সে সব সময় অসুস্থ থাকে। এটা নিয়ে সৎ মায়ের চিন্তার শেষ নেই, সে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আ-হারে বড় ছেলেটা আমার জান, আমার যত কষ্টই হোক ওকে আমি অনাদর করবো না, অসুখ বিসুখ যাই হোক না কেন সব সময় বুকে আগলে রেখেছি। ওর গায়ে ধুলো মাটি লাগতে দেবো না, কোন কাজ করতে হবে না, আমি ওর মা, আমি আছি কি জন্য। এভাবে সতীনের পুত্র সৎ মা নির্ভর হয়ে পড়ল, খাইয়ে দিলে খায়, খাইয়ে না দিলে উপোস থাকে, সে কোন কিছুই ধরতে পারে না, করতে পারে না। নিজের পায়ে ভর দিয়ে কোনদিন খাঁড়া হয়নি, হাঁটা তো দূরের কথা।
৭/৮ বছরের ছেলেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সৎ মা একদিন কঠিনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সয্যাসায়ী হলো , জমে মানুষের টানাটানি, বেশিরভাগ সময়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। সৎমায়ের জীবন বাঁচানো যখন দায়, অন্যরা তখন সতীনের ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। সতীনের ছেলে কান্নাকাটি করে সৎ মায়ের কাছ থেকে সড়তে চায় না, কিন্তু ক্ষুধা তৃষ্ণা প্রসাব পায়খানা তো করতেই হবে। সৎ মা যেহেতু অজ্ঞান তাই অন্যরা ধরাধরি করে বাড়ির উঠানে নিয়ে বসিয়ে প্রসাব পায়খানা করিয়া আনে। মা অসুস্থ কে খাইয়ে দিবে, পেটের খিদায় বাধ্য হয়ে নিজ হাতে খাওয়া শুরু করল, প্রসাব পায়খানায় বসতে বসতে একদিন দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা পায়ে দুই এক কদম হাঁটতে শুরু করল।
এদিকে মাস খানেক পর সৎ মায়ের জ্ঞান ফিরে কিছুটা সুস্থ হতেই সে দেখতে পেল সতীনের ছেলে এক পা দু পা করে বেশ হাঁটছে, নিজে নিজে খাচ্ছে এবং একা একাই প্রসাব পায়খানা করছে, এটা দেখে সে চিৎকার করে উঠলো। আহারে আমি অসুস্থ তাই আমার সোনা জাদুটার কত কষ্ট, কে ওকে মাটিতে নামতে দিয়েছে, আহারে আমি মরে গেলেও আমার বুকের ধনকে মাটিতে নামতে দিতাম না। আয় আয় বাবা সোনা আমার কোলে আয়, এই বলে সে পুনরায় তাকে কোলে তুলে নিতে চাইলো। কিন্তু এরই মধ্যে সতীনের ছেলে নিজ হাতে খেয়ে, এক দুই পা করে হাঁটতে হাঁটতে সে বেশ মজা পেয়েছে। সে হাটতে চায় দৌড়াতে চায়, সে আর সৎ মায়ের কোলে সারাক্ষণ থাকতে চায় না, একটু সুযোগ পেলেই কোল থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে। আর সৎ মা সঙ্গে সঙ্গে বকাবকি করে ধমক দিয়ে কোলে তুলে নেয়। সৎ মা যতই বকাবকি করুক সুযোগ পেলেই সে একা একা হাঁটতে শুরু করে দৌড়াতে চায়, তখন সৎ মা বাধ্য হয়ে সতীনের পুত্রকে হাঁটতে দেখলেই লাঠি নিয়ে বেধড়ক মারপিট করে, গালাগালি করে। গ্রামবাসী ভেবেই হয়রান হঠাৎ করে সৎ মায়ের কি হলো, মনে হয় অসুখে ভুগে ভুগে ওর মাথাটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
কিন্তু সৎ মায়ের মাথা একটুও নষ্ট হয়নি, সে সবকিছুই ঠান্ডা মাথায় করে আসছিল। সে চেয়েছিল কোলের মধ্যে রেখে সতীনের ছেলেকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলবে। সে যেন কোনদিনই তার পেটের ছেলের সমকক্ষ হতে না পারে। রাজনীতির ময়দানে এমন দু-মুখো সৎ মায়ের হিসেব নেই। আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীরা ইসলামপন্থী একটি দলকে সব সময় জঙ্গি, মৌলবাদী, উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বলে। হিন্দু বিদ্বেষী, প্রতিক্রিয়া শীল, নিজ ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের কেউ তাদের কাছে নিরাপদ নয়, এমনকি তারা প্রতিবেশী সাথেও সুসম্পর্ক রাখবে না। এইসব অপবাদ প্রচার করে ঐ দলটিকে এক ঘরে করে রাখার চেষ্টা করে। এতেই তাদের লাভ। কারণ সতীনের ছেলে পঙ্গু হলে নিজের ছেলে কোন না কোনভাবেই ক্ষমতায় যাবে।
তাইতো দেখা যায় ইসলামপন্থী দলটি যখন অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে একসাথে এগিয়ে যেতে চায়, দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত, চাঁদাবাজ মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, ইনসাফভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তখনই ওদের আসল রূপ ফুটে ওঠে। তোমরা অন্য ধর্মের, অন্যমতের সকলের সাথে একসাথে বসবে কেন? হাঁটবে কেন? অন্য ধর্মের কারো হাত ধরবে কেন? কিন্তু ওদের জন্য সাত খুন মাফ। ঠিক যেমন — চালুনী বলে সূচ, তোমার পিছনে ফুটা। নিজেদের জন্য অমুসলিমদের সাথে একাধিক বৈঠক করা, তাদের নিকট সাহায্য কামনা করা হালাল আর ইসলামপন্থী দলের জন্য সেটা যেন শতভাগই হারাম। এরা চায় ইসলামপন্থী দল হিসেবে যে মৌলবাদী ট্যাগ বহন করছে সেই বদনাম যেন মুছে ফেলতে না পারে, মৌলবাদী জঙ্গিবাদী পর ধর্ম বিদ্বেষী ট্যাগ যেন অতিক্রম করতে না পারে। কোন দলেই যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পায়, নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে উপরে উঠতে না পারে।
নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে থাকো কোন সমস্যা নেই, আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী দলগুলোকে মৌলবাদী সন্ত্রাসী পরধর্মে বিদ্বেষী উগ্র সম্প্রদায়িক যাই বলুক না কেন তারা সহযোগিতা ও সমর্থন সবকিছুই করবে, কিন্তু তাদের বেঁধে দেওয়া সীমারেখা ও নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে গুলবাদী জঙ্গি উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক ও পরধর্মে বিদ্বেষী বদনাম থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এক পা দুই পা করে হাঁটতে শিখতে গেলে ওরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। এইতো হাঁটা শিখে ফেলছে, কিছুদিন পরেই দৌড়াতে থাকবে, তখন আর নির্দিষ্ট সীমা ও গন্ডির মধ্যে আটকে রেখে জঙ্গি, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বলা যাবে না। ওরা আন্তর্জাতিকভাবে পরমত সহিষ্ণু, অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সৎ প্রতিবাসী সুলভ আচরণকারী বলে স্বীকৃতি পাবে। তাহলে তো নিজের আসৎ সন্তানেরা বঞ্চিত হবে, ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার সিটে-ফোঁটাও সুযোগ থাকবে না। তাইতো–” মনের দুঃখে বনে যাওয়ার আগে’ লাঠি হাতে মারতে আসে, নিজেরা সফল না হলে ইসলাম পন্থী কোন দরবারী আলেমকে সহযোগী বানিয়ে বিরোধিতা শুরু করে দেয়। ইসলাম বিরোধী রাজশক্তির পুতুল হিসেবে কিছু পদধারী তথাকথিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব জ্ঞানের স্বল্পতা ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে বলতে থাকে– “আকীদা ভ্রষ্ট হয়েছে, অন্য ধর্মের প্রতিনিধিদের সাথে মিশে, বিশেষ করে অমুক অমুককে দাওয়াত দিয়ে দ্বীন ইসলামকে নাপাক করে ফেলেছে”। এতেও ক্ষান্ত হয় না পত্র-পত্রিকা সামাজিক মাধ্যমে বিবৃতি ,ধমক দিয়ে গাল ফুলিয়ে চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখাতে চায়। কিন্তু এতদিন পর যে এক পা দু পা করে হাঁটতে শিখেছে সে তো কারো কথা মানছে না, তাইতো ধমকে রাগে কোন কাজ না হলে তার পাশাপাশি মুখে ফুটে অশ্লীল গালিগালাজ কিংবা ফতোয়ারবান নিক্ষেপ করা শুরু করে, যা বলার বা লেখার ভাষা ও রুচি আমাদের নেই।
লেখক: ইবনে শাহ
বিশিষ্ট কলাম লেখক ও রাজনীতিবিদ